ইদানীং একটা প্রশ্ন প্রায়ই আসে… কিভাবে জব নিয়ে বিদেশে যাওয়া যায়?
আমি সম্প্রতি একটা চাকরী নিয়ে জার্মানিতে আসি। ট্রিভাগো নামে একটা কোম্পানিতে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে জয়েন করেছি। গত কয়েক মাসে পরিচিত অনেকেই বাংলাদেশ থেকে জব নিয়ে বিদেশে গিয়েছেন। আগের অফিসের কয়েকজন পরিচিতি কলিগ জার্মানি এসেছেন। কিছুদিন আগে আরেক বন্ধু নেদারল্যান্ড আসল। এক বড় ভাই জাপান যাচ্ছেন। আরেক বড় ভাই পরিবার নিয়ে সাউথ কোরিয়াতে গেল কয়দিন আগে। ইদানীং চাকরী নিয়ে বিদেশ যাওয়ার একটা ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে দেশে। আমি জার্মানি আসার পর পরিচিত অনেকেই জানতে চেয়েছেন কিভাবে জব নিয়ে বিদেশে আসা যায়। ফেসবুকে অনেক প্রশ্ন পেয়েছি এ ব্যাপারে। সবাইকে একই প্রশ্নের উত্তর বার বার দেয়া সময় সাপেক্ষ। তাই ভাবলাম, একটা ব্লগ/ভ্লগ করি, যেখানে কমন সব প্রশ্নের উত্তর আর আমার অভিজ্ঞতা শেয়ার করা যাবে।
কেন বিদেশ যাবেন?
সব কিছুর আগে নিজের ভেতরে একটা প্রশ্ন আসা উচিৎ, সেটা হচ্ছে “দেশ ছেড়ে কেন বিদেশে যাব?”
কেন দেশ ছেড়ে বিদেশে যাবেন এইটা খুবই ব্যক্তিগত। কেন আপনি বিদেশ যাওয়ার চিন্তা করছেন এইটা শুধুমাত্র আপনিই ভাল জানেন। তবে দেশ ছেড়ে বিদেশে যাওয়া অনেক কঠিন একটা সিদ্ধান্ত, বিশেষ করে যদি আপনার কোনরকম পিছুটান থাকে। বাবা-মা, পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধব সবাইকে ছেড়ে একদম নতুন পরিবেশে এসে থাকা, জীবন-যাপন করা একদম সহজ ব্যাপার না। সাথে যদি আপনার উপর পরিবারের কোন দায়িত্ব থাকে সেইদিক চিন্তা করলে আরো অনেক কষ্টকর হয়ে যায়।
তবে দেশ ছেড়ে একদম অন্য পরিবেশে এসে থাকা এক রকমের অ্যাডভেঞ্চারও বটে! আপনি এমন অনেক অনেক কিছু দেখবেন, অনেক কিছু সম্পর্কে জানবেন যা নিজের এলাকায় বসে কাটিয়ে দিলে হয়ত কখনোই দেখতেন না, অথবা জানতেন না। পৃথিবীর অনেক অনেক আকর্ষণীয় ব্যাপারই হয়ত আপনার অজানা থেকে যেত। যদিও ইন্টারনেটের যুগে এখন অনেক কিছুই সহজ, অনেক তথ্য নিমিষেই পাওয়া যায়। কিন্তু বাস্তব জীবনে দেখা বা অভিজ্ঞতা করার ব্যপারটাই পুরো ভিন্ন। এই একটা কারণে আমি মুভি/সিনেমা খুব বেশী একটা না দেখে গেম খেলি বেশী। গেমের ভিতরে যেই গল্পটা থাকে তা নিজের মত করে উপভোগ করা যায়, যেহেতু প্লেয়ারের কন্ট্রোল আমার হাতে। চাইলেই গল্পের একদম ভিতরে চলে যাওয়া যায়। যাই হোক, এইটা সম্পূর্ণ নিজের অভিমত। কোন রকমের মোটিভেশন না। ক্ষণস্থায়ী জীবনে উপভোগ করার মত অনেক কিছুই আসবে, কিন্তু সেই রকমের সময় পাওয়া যাবে না। তাই কিছু ব্যাপার ত্যাগ করতেই হবে। আস্তে আস্তে ধরতে হবে শুধুমাত্র সেই সব ব্যাপারগুলো যেটা আমার নিজের জন্য ভাল, অথবা নিজের বেশী ভাল লাগে। নিজের সময়টা যাতে সবচেয়ে ভালভাবে উপভোগ করা যায় সেদিকেই মনোযোগ দেয়া উচিৎ।
বিদেশ যাওয়া সহজ নাকি কঠিন?
আমি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং চাকরী নিয়ে বিদেশে এসেছি। আমাদের ব্যাকগ্রাউন্ডে যারা আছেন যেমন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, কোয়ালিটি অ্যাস্যুরেন্স/টেস্ট ইঞ্জিনিয়ার, টেকনিক্যাল প্রোডাক্ট ম্যানেজার, তাদের জন্য এখন ব্যাপারটা আগের চেয়ে অনেক সহজ। আপনার ভাল প্রোফাইল অথবা অভিজ্ঞতা থাকলে দেশের বাহিরের কোম্পানিগুলো তে চাকরী পাওয়া খুবই সহজ। সাথে বিভিন্ন কোম্পানি ইদানীং রিলোকেশন প্যাকেজ অফার করে। দেশ থেকে আসার সময় যাবতীয় অনেক খরচ (ভিসা প্রসেসিং ফী, ফ্লাইট টিকেট, আসবাবপত্র স্থানান্তর ফী, বিদেশে রেসিডেন্ট পারমিট ফী, ইত্যাদি) আপনার কোম্পানি বহন করবে এমন অফার পাওয়া যায়।
কোন দেশ/শহরে যাব?
দেশ/শহর নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার। কিছু পরিচিত মানুষ আছেন, তারা অনেকে বলেছেন, বাহিরে যে কোন একটা দেশে যেতে পারলেই হল। ব্যাপারটা কিন্তু এত হেলা ফেলায় দেখলে হবে না। আপনি হয়ত বলতে পারেন, বিদেশ মানেই দেশ থেকে ভাল, এটা সব সময় সত্যি নাও হতে পারে। কোথায় গেলে ভাল হবে সেটা আপনাকে কেউ বলে দিতে পারবে না। এই জন্য আপনার নিজের রিসার্চ করতে হবে। এই যেমন আমি এখন জার্মানির ডুসেলডর্ফ শহরে থাকি। আমি যদি আমার এই এলাকার অভিজ্ঞতা শেয়ার করি সেটা কিন্তু পুরো জার্মানিকে তুলে ধরে না। আমার কয়েকজন বন্ধু জার্মানির বার্লিন, কোলন, স্টুটগার্ট শহরে থাকে। তাদের সাথে আলাপ করতে গেলে দেখা যায় বার্লিন, স্টুটগার্ট আর ডুসেলডর্ফের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। কাজেই একটা শহরে থাকা মানেই কিন্তু পুরো দেশের অভিজ্ঞতা নিয়ে নিলাম এমন কিন্তু না। আপনার কোথায় গেলে ভাল হবে, কোথায় আপনার ভাল লাগবে সেটা আপনাকেই খুঁজে বের করতে হবে। কোন এলাকার সংস্কৃতি কেমন, আপনার ব্যক্তিত্ব, পছন্দ এসব কিছুর সাথে মানিয়ে নিতে পারবেন কিনা সেটা দেখতে হবে। কারণ আপনি যেই চাকরীর জন্য যাচ্ছেন সেটা আপনি করবেন দিনে ৬-৮ ঘণ্টা। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাকী পুরোটা সময়, সাথে উইকেন্ডও কাজের বাহিরেই কাটাতে হবে।
জীবনের “core values”
আপনার জীবনের “core value” বা “মুল অর্থ” যা আছে, তা ঠিকঠাক ভাবে বজায় রাখতে পারবেন কিনা। এটা খুবই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সময়ের সাথে অবশ্যই জীবনে পরিবর্তন আসবে। কিন্তু না জেনে এমন এক জায়গায় যাওয়ার কারণে আপনার জীবনের যেই অর্থ সেটা যদি আর নাই থাকে তাহলে কিন্তু জীবনটা আর উপভোগ করা গেল না। পরিবারের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আমার দেশের বাহিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। যখন দেশের বাহিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই, তখন কিছু বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজন বলছিল আমেরিকা অথবা কানাডা যেতে, তাহলে অনেক পয়সা কামানো যাবে।
আমার জীবনের “core values” চিন্তা করলে পয়সা কামানো অবশ্যই একটা বড় ফ্যাক্টর। কিন্তু অনেক পয়সা কামিয়ে তাড়াতাড়ি ধনী হয়ে যাব, গাড়ি-বাড়ি করব এইটা আমার লক্ষ্য না। আমি জীবনটাকে উপভোগ করতে চাই। সেই সাথে আমার পরিবারকেও ভালভাবে সাপোর্ট দিতে চাই। যখন একটু রিসার্চ করলাম, তখন দেখলাম ইউরোপে অধিকাংশে “employment law” অনেক কঠিন। সময়মত অফিস শেষ হবে, নির্ধারিত সময়ের অতিরিক্ত কাজ করতে হবে না। তাই অফিস শেষে ভাল পরিমাণের ব্যক্তিগত সময় পাওয়া যায়। আরো দেখলাম ব্লু-কার্ড থাকলে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এর সব কয়টা দেশে বিনা ভিসায় ঘুরতে যাওয়া যাবে। ঘুরাঘুরি ভাল লাগে বলে এই পয়েন্টটা আমার অনেক আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। কিন্তু এখানে ট্যাক্সের পরিমাণ অনেক বেশী। বেতনের প্রায় অর্ধেক চলে যাবে ট্যাক্স দিয়েই। তারপরে বাসা ভাড়া, বিল, খাওয়া-দাওয়া, ও অন্যান্য খরচ হিসাব করলে খুব কম পরিমাণ পয়সা বাকি থাকে। যেইটা জমিয়ে খুব তাড়াতাড়ি ধনী হওয়া সম্ভব না। কিন্তু এইটা আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ না। কারণ তাতেই আমি আমার পরিবারকে ভালমত সাপোর্ট দিতে পারব। তাই সব মিলিয়ে আমার ইউরোপ পছন্দ হয়েছে। আমি যখন বাহিরের চাকরী খোঁজা শুরু করি তখন জার্মানির সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা ভাল ছিল। অনেক চাকরী ছিল, এখনো আছে। তবে এই অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে সময়ের সাথে।
বর্ণবাদ ও ধর্মীয় অনুভূতি
এছাড়াও বর্ণবাদ, ধর্মীয় অনুভূতির ব্যাপার আছে। এইগুলো চিন্তা করাও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে সবার গায়ের রং কাছাকাছি, তাই বর্ণবাদ ব্যাপারটা হয়ত আমরা খুব ভালভাবে বুঝি না। মুসলিম প্রধান দেশে থাকি বলে যারা মুসলমান আছি, তাদের একটা বড় অংশ ধর্মীয় অনুভূতির ব্যাপারটাও হয়ত খুব ভাল বুঝতে পারি না। ভিন্ন ধর্মের মানুষ যারা আছে, তারা প্রায়ই হীনমন্যতায় ভুগে অন্যদের অনেক কঠিন ও ব্যাথাদায়ক কথার কারণে। যেটা সবাই অনুধাবন করতে পারে না। আমরাও ছোট থাকতে মাঝে মাঝে ভিন্ন ধর্মী মানুষের অনেক কটাক্ষ করে কথা বলতাম, শুধু নিজে মজা পাওয়ার জন্য। কখনো বুঝার চেষ্টা করতাম না তাদের কেমন লাগে। আপনি যেই এলাকায় যেতে চাচ্ছেন ওই এলাকায় যদি আপনি সংখ্যালঘু হন এবং এইরকম বর্ণবাদের শিকার হন, অথবা আপনার ধর্মকে কেউ কটাক্ষ করে কথা বলে সেটা মেনে নিতে পারবেন? নাকি এমন কোন এলাকা খুঁজবেন যেখানে আপনি আপনার মত ধর্ম পালন করতে পারবেন কোন সমস্যা ছাড়াই।
শেষ কথা
আপনার জীবনের “core values” কি কি সেটা ভালভাবে বসে একবার চিন্তা করুন। তারপর সম মিলিয়ে একটু ঘাটাঘাটি করুন আপনার জন্য বাংলাদেশের বাহিরে পৃথিবীর কোন এলাকাটা সবচেয়ে উপযোগী? কারণ আপনি যখন কাজের মধ্যে থাকবেন তখন হয়ত সব ব্যাপারগুলো অনুধাবন করবেন না। কিন্তু কাজের বাহিরেও যে আলাদা একটা ব্যক্তিগত জীবন আছে সেইটা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই মাঝে মাঝে। সেই জীবনটাও আসলে উপভোগ করা দরকার। সেই চিন্তাটাই সবার আগে করা উচিত বলে আমি মনে করি। 🙂
পরের পর্বের লিঙ্কঃ aniskhan001.me/life/জব-নিয়ে-কিভাবে-বিদেশে-যাওয়া-যায়-পর্ব-১
ব্লগটা ভিডিও আকারে দেখতে চাইলেঃ