জার্মানি এসেছিলাম শুধু একটা লাগেজ আর একটা কার্টন নিয়ে। লাগেজে ছিল কাপড়-চোপড়, সবজি কাটার ছুরি, ছোট প্লেট বাটি, ইত্যাদি আর আম্মার হাতে বানানো এক প্যাকেট শুকনা করে ভাজা গরুর মাংশ, যাতে পৌঁছে কিছু অন্তত খেতে পারি। কার্টনে করে বালিশ নিয়ে আসছিলাম। এক বন্ধু বলেছিল জার্মানির বালিশ গুলা নাকি ভাল না, আরাম পাওয়া যায় না। অবশ্য পরে এসে দেখেছি আসলে ভাল বালিশ পাওয়া যায়। তবে স্বভাবতই দাম অনেক বেশী।

অল্প কিছু টাকা পয়সা আনতে পেরেছিলাম। যাতে প্রথম মাসের ভাড়া দিতে পারি। পরের মাসের ভাড়া প্রথম বেতন পেলে দিব। দেশে আমার কোন রকমের সেভিংস ছিল না। একদমই না। বন্ধুদের অনেকেই এটা বিশ্বাস করে না। 🙂

প্রায় শুন্য থেকেই শুরু করতে হয়েছে এখানে। বেতন পাব, ভাড়া দিব, বাজার করব, খাবার দাবাড় হবে। পারলে কিছু সেভিংস করব। এভাবেই মাসের পর মাস চলবে আরকি।

বউকে যখন জার্মানিতে আনি তখন নতুন বাসা নিতে হবে। কারণ আগেরটা অনেক ছোট। মাত্র একটা রুম, সেখানেই কিচেন। নতুন বাসা খুঁজতে গিয়ে দেখি জার্মানিতে বাসা খুঁজে পাওয়া অনেক কঠিন। প্রায় ৬ মাস খোঁজার পরে একটা বাসা পাই যেটা বাড়িওয়ালা আমাদের ভাড়া দিতে রাজি হয়। বাড়িওয়ালা ইংরেজি বলতে পারে না, আর আমি জার্মান পারি না। তাই আমার এক কলিগকে নিয়ে আসলাম যাতে ও আমার হয়ে জার্মান ভাষায় কথা বলতে পারে।

ভাড়া ৮০০ ইউরো করে দিতে হবে। সাথে অন্যান্য বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির বিল আলাদা নিজের। জার্মানিতে বাসা ভাড়া নেয়ার আগে অগ্রিম ৩ মাসের ভাড়া অ্যাডভান্স দেয়াটা মোটামুটি কমন প্র্যাকটিস। অগ্রিম ৮০০x৩ = ২৪০০ ইউরোর পরিবর্তে বাড়িওয়ালা কোন এক কারণে ১০০০x৩ = ৩০০০ ইউরো চায়।

সমস্যা হয় ২টা এখানে।
১. আমি যে খুব ভাল ইংরেজি বলতে পারি ব্যাপারটা এমন না। আমার কলিগকে বুঝাতে পারছি না এটা ৩০০০ এর জায়গায় ২৪০০ হওয়া উচিৎ। যাতে ও আমার হয়ে বুঝাতে পারে অ্যাডভান্স এর টাকাটা কম রাখে।
২. আমার কাছে টাকা নাই। আমি আসলেই গরীব।

কোন রকম আলাপ শেষ করে চলে আসি। ১ সপ্তাহ পরে কন্ট্রাক্ট সাইন করতে হবে। কিছুক্ষন বিছানায় শুয়ে থাকি। অনেক বেশী মন খারাপ হয়। ভাষা জানি না বলে ৬০০ ইউরো বেশী দিতে হবে এটার ব্যাপারে কোন কথা বলতে পারলাম না। আর টাকা যে নাই এইটা কিভাবে ম্যানেজ করব সেটা নিয়েও একটা চিন্তা আছে।

পরের দিন নিক্সনকে মেসেজ দিলাম, আমার এই পরিমান টাকা লাগবে। ও দিতে পারবে বলল। সাহস পেলাম। তারপর ঠাণ্ডা মাথায় বাড়িওয়ালাকে যা বলতে চাই তা ইংরেজিতে লিখে গুগল ট্রান্সলেট করে সেটা প্লে করে শুনালাম। সে তখন রাজি হল যে ২৪০০ ইউরো দিলেই হবে। খুশিতে তখন নাচতে মন চাচ্ছিল। তখনও টাকা পয়সা ম্যানেজিং এ খুব নাদান ছিলাম।

নতুন বাসা ভাড়া পাওয়ার পরে খরচ একদম কমিয়ে দিয়েছিলাম। আমি আগে থেকেই মোটামুটি মিতব্যায়ি। কিন্তু নতুন বাসায় উঠার পর থেকে খরচের লাগাম খুব ভালভাবে ধরলাম। খুব সংকীর্ণ ভাবে জীবন-যাপন শুরু করলাম টাকা জমানোর উদ্দেশ্যে। ধার করা টাকা শোধ করতে হবে একটা চিন্তা তো আছেই। পাশাপাশি আরেকটু বেশী যাতে জমাতে পারি সেই চিন্তাও শুরু হল। কিভাবে ইফেক্টিভ ভাবে টাকা জমানো যায় সেই বিষয়ে একটু পড়াশুনাও করলাম। আলহামদুলিল্লাহ্‌, অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই ধার করা টাকা শোধ করতে পারি। কিন্তু আগের মত টাইট ভাবে কম খরচ করে টাকা জমানো অব্যাহত রাখলাম। আমার বউ আমাকে অনেক হেল্প করেছে এই ব্যাপারে। ও এই সময়ে খরচের ভয়ে তেমন কিছুই কিনতে চায়নি। নিয়মিত কয়েক মাস টাকা জমাতে পারছিলাম এটা উপলব্ধি করে ভাল ফীল হচ্ছিল। একই সাথে টাকা জমানোটা তখন অনেকটা নেশার মত হয়ে গেল। জমানো টাকা কিভাবে কাজে লাগানো যায় সেটা নিয়েও একটু পড়াশুনা করতে লাগলাম, যাতে জমানো টাকার মান কমে না যায়। এভাবেই আস্তে আস্তে স্টক মার্কেটে রেগুলার ইনভেস্ট করা শুরু করলাম।

প্রায় ৪ বছর আগের এইসব কথা মনে পরে কিঞ্চিৎ হাসি আসল। কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছিল এক সময় ৬০০ ইউরো বেশী দিতে হবে বলে। কেমন একটা দিন পার করে আসছি।


গত মাসে কোপেনহ্যাগেন 🇩🇰 গিয়েছিলাম একটা কনফারেন্সে অংশগ্রহন করার জন্য। সাথে বউকে নিয়ে গিয়েছিলাম। যাতে ৩ দিনের কনফারেন্স শেষে ২ দিন একটু ঘুরাঘুরি করে আসতে পারি।

এয়ারপোর্টে গিয়ে প্রথমেই ফ্লাইট মিস করলাম। এটা আমার ভুল ছিল, আমি ফ্লাইটের মাত্র ১ ঘণ্টা আগে এয়ারপোর্ট পৌঁছেছি। মনে মনে ধারণা করেছিলাম সিকিউরিটি চেক-ইন করতে ডুসেলডর্ফ এয়ারপোর্টে তো গড়ে মাত্র ১০-১৫ মিনিট লাগে, সমস্যা হবে না। কিন্তু সেদিনই কোন এক কারণে চেকইন লাইন অনেক বড় হয়ে যায়। আমাদের প্রায় ৫৫ মিনিট লাগে লাইন পার করে চেকইন করতে। ফ্লাইট ছাড়ার ১০ মিনিট আগে গেটে গিয়ে পৌঁছালাম। ততক্ষনে গেট বন্ধ। রিকুয়েস্ট করলাম যে আমাদের যেতে দেয়ার। কিন্তু গেটে থাকা অফিসার বললেন এখন আর সম্ভব না। তারা অলরেডি আমাদের নাম কয়েকবার অ্যানাউন্স করেছে আমরা সময় মত পৌঁছাতে পারি নাই। ভিড়ে ছিলাম তাই খেয়ালও করি নাই কখন নাম ধরে ডেকেছিল। ফ্লাইটের আশা ছেড়ে দিলাম। গেটের অফিসার বললেন, আজকে সন্ধ্যায় আরেকটা ফ্লাইট আছে চাইলে ওইটার টিকেট কেটে যেতে পারেন আপানারা।

টিকেট চেক করে দেখি প্রায় ৬০০ ইউরো ওয়ান ওয়ে টিকেট! অবাক হলাম, এখান থেকে কোপেনহ্যাগেন যেতে মাত্র ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট লাগে। কিভাবে টিকেট এর দাম এত বেশী হয়! শেষ মুহূর্তে ইমারজেন্সি ফ্লাইটগুলা বেশীরভাগ সময়ে এমনই হয় হয়ত। বউয়ের সাথে আলাপ করছিলাম কি করা যায়। না গেলে কনফারেন্স মিস হবে। ঘুরাঘুরি করে ভাল সময় কাটানোর চিন্তা করেছিলাম, সেটাও বাদ যাবে। তবে অনেক টাকা দিতে হবে ভর্তুকি হিসেবে। বউকে জিজ্ঞাসা করলাম নতুন টিকেট কি নিব? নাকি ট্রিপ ক্যান্সেল করব? ও বলল তুমি সিদ্ধান্ত নাও, ৬০০ ইউরো মানে অনেক টাকার ব্যাপার।

বেশীক্ষণ চিন্তা না করে কেন জানি টিকেট কেটে ফেললাম। যাচ্ছি তাহলে কোপেনহ্যাগেন! বউও একটু অবাক হল যে এত টাকা দিয়ে টিকেট করলাম। কারণ সাধারণত এমন হুটহাট টাকা খরচ করি না আমি। সেদিন কোন এক কারণে আগের মত সেই খারাপ লাগাটা কাজ করছে না। জানি না কেন, বেশী চিন্তা করতেও ইচ্ছা করছে না। সামনের দিকে তাকিয়ে চলে গেলাম পরের ফ্লাইটের দিকে।

যাওয়ার পরেও তেমন কোন আফসোস হয়নি। কনফারেন্সে জয়েন করলাম। টেকনিক্যাল ব্যাপার সেপার আর ওয়ার্ক কালচার সম্পর্কে অনেক কিছু শিখলাম। বড় বড় ইন্ডাস্ট্রি লিডার যেমন মার্টিন ফাওলার, কেন্ট বেক দের মত ব্যাক্তিদের কাছ থেকে সরাসরি অনেক কিছু জানলাম। কনফারেন্স শেষে ডেনমার্কে থাকা আমাদের এক আত্মীয়ের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করে আসলাম। সব মিলিয়ে ভাল সময় কেটেছে।

ঘুরে ফিরে বাসায় এসে একটু চিন্তা করলাম ব্যাপারটা নিয়ে কি হল আসলে? যা হল তা হচ্ছে জীবন থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা। অবচেতন মন আমাকে তখন অটোমেটিক সেই সিদ্ধান্ত দিয়ে দিয়েছে। ফ্লাইট মিস হয়েছে? সমস্যা নাই, আরেকটা ফ্লাইট নিয়ে যাওয়া যাবে। তাই হয়তো তৎক্ষণাৎ টিকেট করে চলে গিয়েছি।

এই ঘটনা থেকে উপলব্ধি ২টা।

প্রথমতঃ জীবনে এত এত ভুল ডিসিশন নিয়েছি যে এখন মাঝে মাঝে কিছু ভুল ডিসিশন নিলে আর আগের মত গায়ে লাগে না। এখন ভুল থেকে কি শিখলাম সেটার দিকে ফোকাস বেশী থাকে। ভুল হয়েছে, সমস্যা নাই, সমাধান করা যাবে। হয়তো সময় বেশী অথবা টাকা বেশী দিতে হবে, অথবা দুইটাই একসাথে দিতে হবে। এইটাও নিজের জন্য এক রকমের ইনভেস্টমেন্ট। ভুল থেকে শিখে একই ভুল যাতে পরবর্তীতে আর না হয়। যতই তাড়াতাড়িই এয়ারপোর্টে চেক-ইন হোক না কেন, হাতে সময় নিয়ে যাওয়া উচিৎ। এই কারনেই হয়ত সব সময় সাজেস্ট করা হয় এয়ারপোর্টে অন্তত ফ্লাইটের ২ ঘণ্টা আগে যেতে। ডেনমার্কের ফ্লাইট মিস করেছি বলে ৬০০ ইউরো দিয়ে নতুন টিকেট করা লাগছে। বাংলাদেশের টিকেট হলে হয়ত সেটা আরও ৩-৪ গুণ বেশী হতে পারত।

দ্বিতীয়তঃ টাকা হচ্ছে একটা টুল। যার যত বেশী, তার তত বেশী স্বাধীনতা। তবে যে টাকা যত ভাল ম্যানেজ করতে পারে, সে তত আত্মবিশ্বাসী। ৪ বছর আগের আমি এই ঘটনায় পরলে হয়ত তখন দিশেহারা হয়ে যেতাম। কি করব বুঝে উঠতে পারতাম না। তবে এখন হুট করে ৬০০ ইউরো খরচ করার ব্যাপারটা খুব গায়ে লাগে নি। সেই রকম আর্থিক আর মানসিক সামর্থ্য আল্লাহ্‌ এখন আমাকে দিয়েছেন, আলহামদুলিল্লাহ্‌!


টাকা-পয়সা নিয়ে আমার আরও কিছু উপলব্ধি হয়েছে বিগত কয়েক বছরে। পরে হয়ত কখনও শেয়ার করব। আপাতত এটা বলেই শেষ করি… Lots of money will probably make you happy. But if you master how to manage your money, it will definitely make you happy!